শনিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২১, ০৮:১০ পূর্বাহ্ন
সমীরণ বড়ুয়া:
এ বঙ্গভূমিতে বাঙালির সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য, সাহিত্য সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করে যে সব মনীষী দেশে- বহির্বিশ্বে শান্তির নির্মল সুবাতাস ছড়িয়ে অসামান্য অবদান রেখেছেন- তাঁদের মধ্যে বিশ্বনাগরিক, একুশে পদক প্রাপ্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাহিত্যিক জ্যোতিঃপাল মহাথের অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে সুলেখক, গবেষক, দার্শনিক, সাহিত্যিক, বিদর্শন সাধক, পরোপকারী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মানবতাবাদী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি থেরবাদী বৌদ্ধদের ১০ম সংঘরাজ, পণ্ডিত জ্যোতির্ময় বহু গ্রনে’র প্রণেতা, সুদেশক।
মহামান্য সংঘরাজ পণ্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের ১৯১৪ সালে কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানার কেমতলী বরইগাঁও গ্রামীণ জনপদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯২৬ সালে প্রব্রজিত হন। ১৯৩৮ সালে উপসম্পদা লাভ করেন। তাঁর উপাধ্যায় ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলাস’ জোবরাপাড়া নিবাসী খ্যাতিমান সাংঘিক ব্যক্তিত্ব উপসংঘরাজ গুনালঙ্কার মহাথের। তিনি উপসম্পদা লাভের পর বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনে জ্ঞান লাভের জন্য পালি সাহিত্য চর্চা ও বিদর্শন ধ্যান সাধনা শুরু করেন।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন’গুলো হচ্ছে – কর্মতত্ত্ব পুগ্গল পঞ্ঞক্রতি, মালয়েশিয়া ভ্রমণ কাহিনী, বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামে, বোধিচর্যাবতার, সাধনার অন্তরায়, বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা, সৌম্য সাম্যই শান্তির কারণ, প্রজ্ঞাভূমি নির্দেশ, ভারতে বৌদ্ধধর্মের উত্থান পতন, চর্যাপদ, বুদ্ধের জীবন ও বাণী, উপসংঘরাজ গুণালংকার মহাস’বির, রবীন্দ্র সাহিত্যে বৌদ্ধ সংস্কৃতি, ভক্তি শতকম ইত্যাদি।
তাঁর কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার, উপাধি ও পদবি। তন্মধ্যে এশিয়ান বুড্ডিস্ট কনফারেন্স ফর পিস কর্তৃক এশীয় শান্তিপদক, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক ‘অগ্গমহাসদ্ধম্ম জ্যোতিকাধ্বজ’, সদ্ধর্ম রক্ষায় বিরল অবদানের জন্য বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা কর্তৃক ১৯৭৪ সালে ‘মহাশাসনধর’ উপাধি প্রাপ্ত হন। এছাড়াও আবুরখীল জনকল্যাণ সমিতি কর্তৃক ‘মহাধর্মনিধি’, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবদানের কারণে ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ বিশ্বশান্তি, মানবতা ও নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে অমূল্য অবদানের জন্য তাঁকে ‘বিশ্বনাগরিক’ উপাধি প্রদান করেন।
তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে বিশেষ পুরস্কার ‘একুশ পদক’ লাভ করেন। এখানে বলাবাহুল্য যে তাঁর কর্মজীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল তিনি একজন সর্বত্যাগী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হওয়ার পরও মাতৃভূমিকে স্বাধীন করা ও দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি ১৯৭১ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে। তবে অস্ত্র হাতে নয়, উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, ভালোবাসা ও একান্ত সান্নিধ্যের কারণে এদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে স্বীকৃতি আদায় করতে ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, জাপান, কম্বোডিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ভুটান ইত্যাদি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রে সফর করেছিলেন।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ১৯৮২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিশ্বশান্তি প্যাগোডা প্রতিষ্ঠা করেন। দৃষ্টিনন্দন, অতি মনোরম, মনোমুগ্ধকর ছায়া সুনিবিড় স্নিগ্ধ সবুজ, শান্ত পরিবেশে এই বিশ্বশান্তি প্যাগোডার অবস’ান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ টি বছর তিনি এ বিশ্বশান্তি প্যাগোডাতে অবস’ান করেছেন। বর্তমানে এই প্যাগোডায় আবাসিক ছাত্রাবাসে প্রায় পাচঁশতাধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে। এই প্যাগোডাকে ঘিরে বর্তমানে বৌদ্ধজাদি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সম্প্রতি থ্যাইল্যান্ড থেকে বিশালদেহী একটি বুদ্ধমূর্তি স’াপন করা হয়েছে। সেখানে প্রতিদিন দেশ বিদেশের অনেক পর্যটকের উপসি’তিসহ বৌদ্ধধর্মীয় নর-নারীদের পদচারণায় তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে এ স’ান। এ মহাপুরুষ গত ১২ এপ্রিল ২০০২ সালে পরলোকগমন করেন। পরিশেষে, এই মহাপুরুষের আটারতম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই বিনম্র চিত্তে গভীর শ্রদ্ধা ও বন্দনা।
Facebook Comments