রবিবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২১, ১২:০৬ পূর্বাহ্ন
তাপস বড়ুয়া, বোস্টনঃ
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ, বাঙালির প্রিয় খাদ্য ইলিশ। স্বাদে অনন্য সেই ইলিশের জীবন রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। আর এর পেছনে নায়ক খাগড়াছড়ির এক বিজ্ঞানী। তার নাম ড. মং সানু মারমা।
তাপস বড়ুয়ার সাথে ড. মং সানু মারমা।
রূপালি ইলিশের জীবন রহস্য উদঘাটনে মং প্রায় এক বছর ধরে নিবিড়ভাবে গবেষণা চালিয়েছেন। তিন মহাদেশে বসবাসরত বেশ কিছু বাঙালি বিজ্ঞানীর সহায়তায় তাঁর এই উদ্যোগে সাফল্য এসেছে। মূল গবেষণায় ছিলেন ড. মং। এতে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমেস্ট্রি ও মলিকিউলার বায়োলজির অধ্যাপক ড. হাসিনা খান, যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণারত পোলিশ বিজ্ঞানী ড. পিটার লানাকিয়েভ, বাংলাদেশি বায়ো ইনফরমিটিশিয়ান একেএম আবদুল বাতেন, বিজ্ঞানী নিয়ামুল নাসের, রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ।
ড. মং বলেন, এই গবেষণায় বের হলো পদ্মার ইলিশের জীবন রহস্য। এতে লেখা রয়েছে প্রায় একশ কোটি রাসায়নিক যৌগের অনুবিন্যাস। প্রায় ৩০ হাজার জিনের কারণে ইলিশের জীবনের রহস্য জানা যাবে।
প্রশ্ন হলো, জীবন রহস্য উন্মোচনে কী লাভ হবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গবেষণার ফলে ইলিশ মাছের জীবনচক্র, বংশগতি,বৃদ্ধি, খাদ্যাভ্যাস, আচরণ, রোগ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে। এই তথ্য কাজে লাগিয়ে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি, সমুদ্র ও নদীর বাইরেও অন্যান্য স্থানে কৃত্রিমভাবে ইলিশ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
কীভাবে খাগড়াছড়ির গহীন পাহাড়ের গ্রাম থেকে এত উচ্চতায় পৌঁছলেন মং? খাগড়াছড়ির সিংগিনালা গ্রামে মং সানুর জন্ম। বাবা মং চাই–উরি স্কুল শিক্ষক। মা আবেইমা গৃহিণী। পাহাড়ের স্কুল থেকে পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে। সেখান থেকে পড়তে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এরপর জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে জাপানে লেখাপড়া করেন। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইডি করতে যান। বায়োঅর্গানিক কেমিস্ট্রি ও সিনথেটিক অর্গানিকের ওপর পিএইচডি শেষ করে বর্তমানে তিনি বোস্টনে নিউ জেনারেশন ডিএনএ সিকুয়েন্সিং টেকনোলজির ওপর গবেষণা করছেন।
একটি গবেষণা ল্যাবে চাকরি পাওয়ার সুবাদে প্রায় ১০ বছর আগে বোস্টনে আসেন মং সানু মারমা। বোস্টনে এসে প্রথম আমার বাসায় উঠেছিলেন। সেই সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বড় ভাইয়ের মতো। প্রায় তিন বছর আগে থেকেই তিনি এই বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করতেন। বোস্টন শহরে বাঙালি মাছের দোকান ছিল একটা। তিনি বলেছিলেন, একদিন ওই দোকানে মাছ কিনতে যাই। দাম জিজ্ঞেস করলে বলে,পাউন্ড ৭ ডলার। দাম শুনে আঁতকে উঠি।
তখনই ড. মং–এর ভাবনায় এল, বাংলাদেশের রূপালি ইলিশকে কীভাবে দেশের মানুষের জন্য সহজলভ্য করা যায়। ভাবনাটা কিছুটা সহজ মনে হলো। কারণ, তিনি দীর্ঘ দিন ধরে ডিএনএ নিয়ে কাজ করছেন। এর মধ্যে তিনি এমন কিছু মৌলিক রাসায়নিক আবিষ্কার করেছেন, যা বিশ্বে ডিএনএ গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই চিন্তা থেকেই ইলিশ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
ড. মং সানু মারমা জানান, তিনি প্রথমে বোস্টনের বাজার থেকে ইলিশ কিনে ডিএনএ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইলিশগুলো এখানে আসতে আসতে অনেক সময় চলে যায়। তাই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হাসিনা খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই উদ্যোগের বিষয়ে জানান।
মং বলেন, ইলিশ মাছ হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তেমন বিনিয়োগও লাগে না। তাই এই আবিষ্কারের ফলে ইলিশ অচিরেই সহজলভ্য হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জিনোম কী? ‘জিন’ ও ‘ক্রোমোসম’ শব্দ দুটি জোড়া লাড়িয়ে জিনোম শব্দটি তৈরি করা হয়েছে। জিনোম হলো প্রাণী বা উদ্ভিদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এই নকশার ওপরই নির্ভর করবে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য। কোনো জীবের জিনোম বলতে সেটির সমস্ত বংশগতিক তথ্যের সমষ্টিকে বোঝায়। তা ডিএনএতে (ডিঅঙিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড)সংকেতে আবদ্ধ থাকে। বংশগতির তথ্য বলতে কোনো জীবের মধ্যে বংশ পরম্পরায় যে তথ্যগুলো উপস্থিত থাকে সেগুলোকে বোঝানো হয়। আমরা পূর্বপুরুষের অনেক বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে দেখতে পাই। এভাবে কোনো জীবের এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্থানান্তরিত বৈশিষ্ট্যগুলোকে বংশগতির তথ্য বলা হয়।
এর আগে পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় ২০১০ সালে তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে তোষা পাটের জিন নকশা উন্মোচন করেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। এছাড়া তিনি ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন, যা পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়।
সুত্রঃ দৈনিক আজাদী
Facebook Comments