মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২১, ০৩:৩২ অপরাহ্ন
ইলা মুৎসুদ্দী:
আমরা ফেসবুকের কারণে এখন ত্রিপিটক নিয়ে খুব বেশী মাথা ঘামাচ্ছি। অথচ আমরা অনেকেই ত্রিপিটক কি এবং কয় খন্ডে বিভক্ত এসব কিছুই জানি না। জানতে চেষ্টা ও করি না। যার কারণে আমরা না বুঝে বেশীর ভাগ সময় কোন একটি লেখা পেলেই অযাচিত মন্তব্য করে বসি। একবার ও চিন্তা করে দেখি না এভাবে মন্তব্য করাটা কতটুকু সমীচিন? যাই হোক এখন আমরা বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে বাস করছি। যেখানে সবকিছুই এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। একটা ক্লিক করলেই অনায়াসে আমরা অনেক কিছুই পেয়ে যাই। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে এখন ত্রিপিটক সবারই হাতের নাগালে। অনলাইনের মাধ্যমে আমরা ত্রিপিটক সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারছি সহজেই। ত্রিপিটকের বই সমূহ না পড়লে আপনি কোনদিনই ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন না। কারণ ত্রিপিটক হচ্ছে বুদ্ধবাণী। আর একজন বৌদ্ধ হিসাবে ত্রিপিটক সম্পর্কে ধারণা থাকা অবশ্যই প্রয়োজন বলে মনে করি। আপনার থেকে এখন অনেক টাকা দিয়ে ব্ই কিনতে হচ্ছে না। শুধুমাত্র ডাউনলোড করে রাখলেই হয়ে যায়। সুবিধামত সময়ে পড়া যাবে। আমাদের একটা বিষয়ে খুবই অনীহা। অনীহা বলেই আমাদের ধর্ম চর্চা খুবই কম হচ্ছে। খুব কম সংখ্যক মানুষ আছেন যারা নিয়মিত এসব বই গুলো পড়েন।
.
আরেকটা বিষয় ধর্ম বিষয়ে না জেনে এমন কোন বাক্যজনিত পাপ সঞ্চয় করবেন না যাতে করে জন্ম-জন্মান্তর আপনার মার্গ লাভের অন্তরায় হয়। আমরা যে কোন বিষয়ে মন্তব্য করি হাজার রকমের। সব জায়গায় হার জিতের মতো ব্যাপার হয়ে গেছে, নিজেকে জেতানোর জন্য ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করি। এসব বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে নিজেদের চরম সর্বনাশ ডেকে আনছি। মনে রাখবেন, কাউকে হেয় করলে, কটাক্ষ করে কিছু বললে জন্ম-জন্মান্তর তার ফল তো আমাকেই ভোগ করতে হবে। কোন গুরু এসে আমাকে উদ্ধার করবে না। আমার কর্মফল আমারই। এটা বুদ্ধের কথা। বুদ্ধ কখনো বলেননি কাউকে মুক্ত করতে পারবেন । বুদ্ধ বলেছেন নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা। তাহলে ভেবে দেখুন কী করবেন? এখনো সময় আছে। সময় থাকতে সাবধান হোন। বুদ্ধ আবার বলেছেন, অতীত নিয়ে বসে থেকো না, ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নিয়ে ও চিন্তা করো না। বর্তমানকে দেখ। তাই সবার প্রতি অনুরোধ রইল, বর্তমানকে দেখুন, জানুন। ত্রিপিটক অধ্যয়ন করুন। বর্তমান সময়ে একটু সচেতন হলেই আমরা অনেক বিষয়ে জানতে পারব। প্রতিদিন ২ পৃষ্ঠা করে পড়ি না তাহলেই তো অনেক পড়া হয়ে যায়। আজ জেনে নিন ত্রিপিটক কি? ত্রিপিটক কয় ভাগে বিভক্ত? ত্রিপিটকের বই পরিচিতি।
.
ত্রিপিটক বৌদ্ধদের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ। বুদ্বের দর্শন এবং উপদেশের সংকলন। পালি তি-পিটক হতে বাংলায় ত্রিপিটক শব্দের প্রচলন। তিন পিটকের সমন্বিত সমাহারকে ত্রিপিটক বোঝানো হচ্ছে। এই তিনটি পিটক হলো বিনয় পিটক, সূত্র পিটক ও অভিধর্ম পিটক।
পিটক শব্দটি পালি এর অর্থ – ঝুড়ি, পাত্র, বাক্স ইত্যাদি, অর্থ যেখানে কোনো কিছু সংরক্ষন করা । ত্রিপিটককে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: ১) অভিধর্ম পিটক, ২) বিনয় পিটক ৩) সূত্র পিটক
ত্রিপিটকের পরিচয়
১) বিনয় পিটক
• পারাজিকা
• পচিত্তিয়া
• চুলবগগ্
• মহাবগগ্
• পরিবার পাঠো
২) সূত্র পিটক
• দীর্ঘ নিকায় (৩ খন্ডে সমাপ্ত)
• মজ্ ঝিম নিকায় (৩ খন্ডে সমাপ্ত)
• সংযুক্ত নিকায় (৩ খন্ডে সমাপ্ত)
• অঙ্গুত্তর নিকায় (৩ খন্ডে সমাপ্ত)
• খুদ্দক নিকায় (১৬ টি সতন্ত্র গ্রন্থ আছে)
o খুদ্দক পাঠো
o ধম্মপদ
o উদান
o ইতিবুত্তক
o সত্তনিপাত
o বিমান বুত্থু
o পেত বুত্থু
o থের গাথা
o থেরী গাথা
o জাতক (৫ খন্ড)
o মহানিদ্দেশ
o চুল নিদ্দেশ
o পটিসম্ভিদা নিদ্দেশ
o অপদান
o বুদ্ধ বংসো
o চরিয পিটক
৩) অভিধর্ম পিটক
• ধম্মসঙ্গণি
• বিভঙ্গ
• ধাতুকথা
• পুগ্ গল পঞ্ঞত্তি
• কথাবত্থু
• যমক
• পটঠান
.
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বুদ্ধের সময়কালে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ ধ্যানে-জ্ঞ্যানে অত্যন্ত উচ্চ মার্গের চেতনা সম্পন্ন ছিলেন। তাদের মধ্যে যে যেই বিষয়ে সাধনা করতেন সে সেই বিষয়ে অত্যধিক উন্নতি সাধন করতেন। এই সময়ে ভিক্ষুদের মধ্যে সুত্রধর, বিনয়ধর এবং মাতিকাধর নামে তিন ধারার সাধনাকারী ভিক্ষু ছিলেন। এই তিন শ্রেণীর ভিক্ষুগণ সকলেই ছিলেন স্মৃতিধর।
.
স্মৃতিধর এই ভিক্ষুগণ শ্রুতি থেকে স্মৃতিতে বুদ্ধ বাণীকে সংরক্ষন করতেন। নিরন্তর অধ্যবসায়ে ভিক্ষুগণ তাদের শিষ্য পরম্পরায় এই রীতি সচল রাখতেন। বুদ্ধের শিষ্যদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেরই এই শ্রুতি ও স্মৃতি ক্ষমতা ছিল। তাই ত্রিপিটক গ্রন্থনের পূর্বে সুত্রধরেরা সূত্র, বিনয়ধরেরা বিনয় এবং মাতিকা ধরেরা অভিধর্ম পিটক স্মৃতিতে রাখতেন।
.
ধর্মস্কন্ধ অর্থ – ধর্ম পরিচ্ছেদ বা বিষয় বিভাগ। অর্থাৎ ত্রিপিটকে বর্ণিত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রত্যেক বিষয়কে এক একটি স্কন্ধ বলা হয়। ত্রিপিটকে এরূপ চুরাশি হাজার (৮৪০০০) ধর্মস্কন্ধ রয়েছে। তার মধ্যে বিনয় পিটকে একুশ হাজার (২১০০০), সূত্র পিটকে একুশ হাজার (২১০০০) ও অভিধর্ম পিটকে বেয়াল্লিশ হাজার (৪২০০০)। এই চুরাশি হাজার বুদ্ধ বচন বা বুদ্ধ উল্লেখিত বিষয় বা শাস্ত্রবাক্য এই ত্রিপিটকে বিদ্যমান।
.
আমাদের জন্য এখন অবশ্যই সুসময়। কারণ এখন পালি থেকে বাংলায় অনুবাদ ত্রিপিটকের খন্ডসমূহ আমরা পাচ্ছি। একটা সময় ছিল যখন এসব কল্পনাই করা যেতো না। মানুষ পালি পড়তে এবং বুঝতে পারত না বলেই ত্রিপিটকের বই সমূহ পড়ার প্রতি অনীহা কাজ করত। এখন সময় পাল্টেছে। সব দিক দিয়েই উন্নতি হচ্ছে। তাই আমাদের মনন মানসিকতার উৎকর্ষতা হওয়া খুবই প্রয়োজন। কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলি প্রয়োজনে নোট করে রাখবেন। তাহলে মনে থাকবে। ত্রিপিটকের যে কোন বই সংগ্রহ করুন, পড়ুন, জানুন এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করুন।
Facebook Comments